আমি চিঠি লিখতাম নীলুকে।
নীলুর সাথে প্রথমে পরিচয়; পরে কলম বন্ধুত্ব। আরও পরে ও আমার বান্ধবী হয়ে যায়।
ঈদের ছুটিতে ঠাকুরগাঁ যাচ্ছিলাম। বি,আর,টি,সি’র তিন জনের সীটের জানালার পাশেরটায় চোখ আটকে যায়। কিছু কিছু মেয়ে চমৎকার হাসতে পারে জানি। কিন্তু হাসির মধ্যেও যে পরিচ্ছন্নতা থাকে, মেলোডি থাকে তা এই প্রথম নজরে পড়ে।মেয়েটার পাশেই আমার বয়সী একটা ছেলে। তার পাশের সিটটাই আমার।
কোচ ছাড়লো। মেয়েটা বকবক করেই চলছে, ছেলেটাও শুনতে পারে বটে। কিছুক্ষণ পর একটা সিগ্রেট ধরাই। মেয়েটা ঝট করে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে নাক চেপে ধরে। সিগারেট ধরানোতে মেয়েটা যে বিরক্ত হয়েছে এটা বুঝি। লজ্জিত হয়ে সিগারেটটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিই। সাথের ছেলেটা বলে-
-কিছু মনে করবেন না। সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না।
আমি আরও লজ্জিত হয়ে পড়ি। বলি না না, আসলে আমারই উচিত হয়নি কোচে সিগারেট ধরানো। এবার মেয়েটা কথা বলে
– আমি নীলু, আপনি ?
– ভিকটর আযম অভি। সবাই অভি। নামেই ডাকে।
– বাড়ি ঠাকুরগাঁয়ে?
– হ্যাঁ।
এবার আমি প্রশ্ন করি
– আপনার ?
– পঞ্চগড়।
নীলু কোচের জানালা দিয়ে ঘরবাড়ি দেখে, মানুষ দেখে। কোচ চলছে। নীরবতা। একসময় নীলুই আবার কথা বলে-
– ঢাকায় কেন?
– লেখাপরা।
– কোথায়?
– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ফাইন আর্টস, শেষ বর্ষ।
– আপনি ? এবার আমি জিজ্ঞেস করি।
নীলু জবাব দেয়
-আমিও পড়াশোনা
– কোথায় কিসে ?
-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতিতে অনার্স।
– থাকেন কোথায়?
-রোকেয়া হল এক্সটেনশান।
– আপনি? আমাকে জিজ্ঞেস করে।
-শাহনেওয়াজ হল। জবাব দিই।
আবার নীরবতা। রাত নামে। কোচ চলছে। নীলার চুল বাতাসের সাথে খেলা করে। আমার চোখ উপভোগ করে।
আরিচা ফেরি ঘাটে কোচ থামে। ফেরি ঘাটে ভিড়তে অনেক দেরি। আমরা তিনজনেই হোটেলে খেয়ে নিই। তারপর তিনজনই হাঁটতে হাঁটতে গল্প করি। নিজেদের ভাললাগা মন্দ লাগা অনেক কিছুই এসে যায় তাতে।
কোচ যখন ফেরিতে ওঠে তখন ওর মামাতো ভাইটা ঘুমিয়ে যায়। নীলু জেগে থাকে, আমিও। দু’জনেই কথা বলি। নগরবাড়ি আসার আগেই নীলু ঘুমিয়ে যায়। আমার চোখে ঘুম আসেনা। মাঝে মধ্যেই ঘুমিয়ে থাকা নীলুর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
ঢাকায় ফিরে গিয়ে ব্যস্ততার কারণে নীলুর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। একদিন হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যায় টি.এস.সিতে। ও তেড়ে আসে
– আপনি তো ভালো লোক না। পুরোপুরি একটা ডাকাত। একটা দিনতো খোঁজ খবর পর্যন্ত নিলেন না।
আমি এটা সেটা বলে দোষ এড়াবার চেষ্টা করি। নীলু মেনে যায়। আমরা অনেকক্ষণ বসে গল্প করি।
সেদিনের পর নীলুর সাথে আমার প্রায়ই দেখা হতে থাকে। ক্লাস না থাকলে শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরীতে যাই। শর্ট ফিল্ম দেখি। যাদুঘরে যাই। পাঠক সমাবেশে গিয়ে ও আমাকে প্রায়ই আমার প্রিয় বিষয় চলচ্চিত্রের ওপর লেখা বই কিনে উপহার দেয়। আমি মাঝে মধ্যে কবিতার বই কিনে ওকে দেই। একদিন আমরা আপনি থেকে তুমি হয়ে যাই। আর একদিন তুমি থেকে তুই হয়ে যাই।
এক শুক্রবারে ও আমার রুমে আসে। আমার ঘরের অগোছালো অবস্থা আর বিছানার চাদর সাদা দেয়ালের যেখানে সেখানে রংয়ের দাগ দেখে রেগে যায়। আমি ওকে বসতে বলি ও আরও রেগে যায়। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে শার্টের কলারটা চেপে ধরে বলে চল আমার সাথে। আমি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করি।
– তুই কি পাগল হয়ে গেলি? বসনা এখানেই গল্প করি।
নীলু চেঁচিয়ে ওঠে
– তুইকি মানুষ না অন্য কিছু অভি? একটু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পারিস না? একটাই মাত্র কথা কতবার বলেছি বলতো ?
আমি ওকে কথা দিই এরপর এমন হবে না। নীলু শান্ত হয়। আমরা দু’জনে রুম থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতেই শাহবাগ আসি। দু’জনে তানভির মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ দেখি। ফুচকা খাই। আবার বসে বসে গল্প করি-
– অভি তুই কত সালে বিয়ে করবি ?
নীলুর এমন একটা প্রশ্ন আমাকে ধাক্কা মারে। সামলে নিয়ে বলি-
– নীলু তুইতো জানিস আমার চেহারা দেখে শতকরা নব্বই জন মেয়ে ভাবে আমি ড্রাগ এডিক্ট। এই বাজে চেহারা দেখে কেউ কাছে ভেড়ে না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে কেউ আমাকে ভালোবাসবে না। আমিও প্রতিজ্ঞা করেছি নো প্রেম নো বিয়ে।
নীলু জোরে হেসে উঠে। তারপর বিষন্ন হয়ে বলে, দেখিস তোর ঘরে একদিন রাজকন্যা আসবে। আমি, নীলু জোরে হেসে উঠি।
এর ক’দিন পরে একদিন সকালে নীলু আমার রুমে আসে। ও হাসে না, আমি বুঝে ফেলি কোথাও কোন গোলমাল আছে। নীলু বলে
– অভি কাল আমার সাথে তোকে পঞ্চগড় যেতে হবে।
আমি ইয়ার্কি করে বলি
-পঞ্চগড় বলছিস কেন তোর জন্য মঙ্গল গ্রহেও যেতে পারি।
নীলু রেগে যায় বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে বলে
-অভি আমি ইয়ার্কি মারতে আসিনি। আর মাত্র তিন দিন পর আমার বিয়ে। বাবা নিতে এসেছেন। তুই আমার সাথে না গেলে কাঁদবো।
-যাবো। আমি নীলুকে বলি।
বিয়ের দিন আমি নীলুর দু’হাতে আলপনা এঁকে দিই তারপর- দু’হাতের আলপনার একটা ক্লোজআপ ছবি নিই। নীলু একটুও কাঁদেনি। কেন জানি না আমি ডুকরে কেঁদেছিলাম আড়ালে।
নীলুর স্বামী কুষ্টিয়ায় চাকরি করে। পরের দিনই নীলুকে সেখানে নিয়ে যায়। আমি ঢাকায় চলে আসি। নীলু কুষ্টিয়া থেকে সপ্তাহে দুটো চিঠি লিখতো। অনেক কিছুই লিখতো। যা মনে হতো তাই লিখতো। আমিও লিখতাম। এটা একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
একদিন একসাথে দুটো চিঠি পাই। একটা নীলুর অপরটা অপরিচিত হাতের লিখা। খামের ওপর প্রেরকের নামও নেই। এটাই আগে খুলি। ছোট ছোট অরের চার লাইনের একটা চিঠি “আমার নাম ইতি। নীলুপার মামাতো বোন। নীলুপাকে লিখা আপনার চিঠিগুলো পড়েছি। আপনি চমৎকার চিঠি লিখতে পারেন। আমাকে লিখবেন?”
নীলুর চিঠিটা খুলি। ও’অনুরোধ করেছে ইতিকে লিখতে। ইতি নীলুর ওখানে বেড়াতে এসে আমার চিঠিগুলো পড়েছে। ইতিকে লিখার ঠিকানা দুটো চিঠিতেই ছিল।
ইতিকে লিখতে শুরু করি। ও আমাকে নিয়মিত লিখে। নীলুর কাছ থেকে চিঠি আসা কমে যায়। অকস্মাৎ একদিন এক চিঠিতে ইতি আমাকে লিখে
আমি তোমাকে ভালোবাসি। সে চিঠিটা আলাদা করে যত্ন করে রাখি। আমার ভালো লাগে।
আমি নীলুকে চিঠি লিখে সব জানাই। নীলু আমার কাছে ইতির পোস্টকার্ড সাইজ রঙ্গিন ছবি পাঠিয়ে দেয়। ছবি পাওয়ার পর থেকে ইতিকে হারাবার একটা ভয় আমাকে পেয়ে বসে। ইতি এ্যাত সুন্দরী এ্যাত-এ্যাত অথচ আমি। ইতির কাছে চিঠি লিখা বন্ধ করে দিই। নীলুর কাছেও চিঠি লিখি না।
অনেকদিন পরে একদিন নীলুর চিঠি পাই। ও লিখেছে ইতি ঢাকা আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে। ইতি ঢাকা আসছে জেনে ভয়টা বেড়ে যায়।
সপ্তাহ দু’পরে জোসেফ ক্লাসে এসে খবর দেয়
-রুমে একটা মেয়ে তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার মন জেনে যায় ওটা ইতি। মনে মনে ঠিক করি এখন রুমে ফিরবো না। অপেক্ষা করে ও চলে যাক।
সন্ধ্যার সামান্য আগে হলে ফিরি। বন্ধুরা সব হৈ হৈ করে আসে।
-দোস্ত রাজকন্যা কোত্থকে জোগাড় করলি ?
কাউকে কিছু না বলে রুমের ভেতর ঢুকতেই দেখি ইতি বসে আছে। চিনতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি। পোষ্টকার্ড সাইজের দেখা সেই ছবিটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ায়। তারপর কিছু না বলেই কাঁদতে শুরু করে। আমিও কেঁদে ফেলি। আমার ভয় কেটে যায়। আমার বুকে ইতি মাথা রাখে। আমি নতুন একটা ছবি আঁকবো বলে ঠিক করি।